ই-নথির গর্জনই হোক :: মুজিব বর্ষের অর্জন

ছোটবেলায় বাংলা রচনা “দূর্নীতি” যখন মুখস্থ করেছিলাম, তখন দুটি শব্দ পড়েছিলাম, “লাল ফিতার দৌরাত্ম্য” এবং ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা”। লাল ফিতায় বাঁধা পেট মোটা ফাইলটাই ছোটবেলায় আমাদের মননে গেঁথে যাওয়া দূর্নীতির প্রতীক। আর আসলে ফাইল খুব দ্রুত বেগে দৌড়ালেই, খুলে যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এটা কোন বিষয় না। বিষয়টা হচ্ছে ফাইল; কেদারা থেকে চেয়ার এর মত বাংলায় ঢুকে যাওয়া একটি পারিভাষিক শব্দ। এর বাংলা হচ্ছে নথি। ইলেকট্রনিক নথিকে সংক্ষেপে ই-নথি বলা হচ্ছে। সরকারি কাজের গতি বাড়াতে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় ই-নথি কার্যক্রম। ই-নথিকে বলা হচ্ছে কাগজহীন সরকারি দপ্তর। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে, কম খরচে ও হয়রানি ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। আগে সাধারণত সরকারি কার্যালয়, দপ্তর বা বিভাগের কার্যক্রম কম্পিউটারে টাইপ করে বা হাতে লিখে পরিচালনা করা হতো। পরে তা সংরক্ষণ করা হতো। এতে সরকারি দপ্তরে ফাইলের স্তূপ জমত, নাগরিকেরা হয়রানির শিকার হতেন। একটি সাধারণ অফিস আদেশ হতে কখনো কখনো তিন থেকে চারটি টেবিল ঘুরতে হতো; আবার হয়ত একেক টেবিল হয়ত একেক ভৌগলিক যায়গায়। ফাইল নিচ থেকে উপরে উঠে আবার বেয়ে বেয়ে নিচে নামে। এ এক জটিল উঠা নামার খেলা। অনেক সময়ই তেল দেয়া বাঁশে বানরের উঠা নামার মতন। ফলে কমে যেত কাজের গতি। এই ধীরগতির কাজকে দ্রুত করতে লাগত ঘুষ বা স্পিড মানি। এখন সেই পেট মোটা ফাইল রাখা নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলার দিন শেষ। ফাইল থাকবে ভার্চুয়াল, কাজ হবে ইন্টেলেকচুয়াল। টেবিলে ফাইল নয়। ওটা থাকবে কারও পকেটে বা ল্যাপটপে। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা ঘরে বসে আবেদন করতে পারেন। একই সঙ্গে ঘরে বসেই নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যান। ফলে দপ্তরে এসে আগের মতো আর হয়রানির শিকার হতে হয় না তাঁদের। সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও দুটি বিভাগের অধীনস্থ কার্যালয়গুলোতে ই-নথির মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজের সূত্রপাত হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের ৯০ শতাংশের দাপ্তরিক কাজ চলছে ই-নথির মাধ্যমে। সরকারি বেশ কয়েকটি দপ্তরের প্রায় ৭০ থেকে ৯৫ ভাগ কাজ করা হচ্ছে ই-নথির মাধ্যমে। যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে সরকারি সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন কর্মকর্তারা। বিদেশে বা ভ্রমণে থাকা অবস্থাতেও দ্রুততার সঙ্গে কাজ হয়ে যায়। কাজগুলো ঝুলে থাকার সুযোগ নেই। ই-নথি নানাভাবে সরকারের কাজের গতি বাড়াচ্ছে। ই-নথির ব্র্যান্ডিংয়ে একটি বিষয়কে ফোকাস করা হচ্ছে; লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমবে। ফাইল আটকে পয়সা খাওয়া দূর হয়ে যাবে। আসলে ই-নথি বিষয়টা এতো সামান্য পরিমান ফলদায়ক নয়। ফাইল আটকে রেখে আসলে আর কত টাকায় খাওয়া যায়? টাকা পয়সা যারা খায় তারা ফাইল সৃষ্টি করেই খায়। এজন্য তাই ফাইল সৃষ্টি থেকেই দরকার স্বচ্ছতা, ধারাবাহিকতা এবং জবাবদিহিতার ভয়। ই-নথিতে থাকছে কে কাকে কখন ফাইল স্বাক্ষর করে দিচ্ছে, একেবারে সময় সহ রেকর্ড। কে কয়দিন ফাইল আটকে রাখল তা তার আমলনামায় উঠতে থাকবে স্পষ্ট ভাবে; অন্য কারো উপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই। সিনিয়র অফিসার জুনিয়র অফিসার কে ব্যাকডেটে ফাইল মার্ক করে দিতে পারবে না ই-নথিতে। সরকারি দপ্তরের স্মারক নাম্বারের খাতায় নম্বর ফাঁকা রাখা থাকা কিংবা নম্বর ওলটপালট করার সুযোগ থাকবেনা ই-নথিতে। সেবাগ্রহীতাকে ব্যাক ডেটে সাইন করা চিঠি দেয়ার কোন সুযোগ নেই। সেবা গ্রহণকারী তার আবেদন দিয়ে চলে যাবে আর নথি সিস্টেম থেকেই তাকে মেসেজ এবং ই-মেইল এর মাধ্যমে পত্র মারফত তার পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তাকে জানানো যাবে। সেবা পাওয়ার যোগ্য হলে পাবে না হলে পাবে না কিন্তু আশায় ঝুলে থাকতে হবে না। সিদ্ধান্ত কিংবা অনুমোদন সবকিছু হবে কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক ই-নথি চালাচালির মাধ্যমে। অধিকিন্তু বছরের শেষে বা নির্দিষ্ট সময় পর অডিট এসে খুঁজতে হবে না অফিসের ফাইল পত্র। কিংবা দূর্নীতির খবর বেরোনোর পর অনুসন্ধানে নামতে হবে না দুদককে। অডিট/দুদক/গোয়েন্দা সংস্থা সবাই নথির ডাটাবেজে নজর রাখলেই, নজর রাখতে পারবে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান এর উপর। তদন্তের স্বার্থে আপনাকে ধুলোমাখা ফাইল নাড়াচাড়া করতে হবে না। এ এক অদ্ভুত সম্ভাবনার, অদ্ভুত আনন্দের বাংলাদেশের হাতছানি। ই-নথির আইডিই হোক সকল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আইডি। তবে একটি দুষ্টু চক্র ই-নথিকে দমিয়ে রাখতে চায়। ই-নথি দমে যাওয়া মানেই, পিছিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ। তাই দেশের স্বার্থে, দিন বদলের স্বার্থে ই-নথিকে ভালোবাসতে হবে। ই-নথি পারি না জানি না এসব বলার সুযোগ নাই। সরকার একেবারে মুখের সামনে চামচ দিয়ে ধরে রেখেছে ই-নথি, না খেয়ে কোন উপায় নেই। a2i এর উদ্যোগে মুক্তপাঠের অনালাইন কোর্স ঘন্টা দুয়েক সময় নিয়ে করলেই ই-নথি শিখে নিতে পারবে যে কেউ। ই-নথি ভালবাসুন; যোগ দিনঃ www.facebook.com/groups/enothi.lovers। ই-নথির গর্জনই হোক মুজিব বর্ষের অর্জন। জয় বাংলা…